রামাদ্বানে সময়ের সদ্বব্যবহারের অপরিহার্যতা পর্ব – ১
প্রবন্ধটি পড়া হলে, শেয়ার করতে ভুলবেন না
পর্ব ১ | পর্ব ২
এ বিষয়ে কথা বলার আগে শুরুতেই আমাদের মনে করিয়ে দেয়া উচিৎ যে কেন রামাদ্বানে সময়ের সদ্বব্যবহার করা অপরিহার্য। ডেভিড অ্যালেন, বিশ্বখ্যাত জি.টি.ডি সিস্টেমের নির্মাতা ব্যাখ্যা করেছেন যখন আমরা কোনো কিছু করতে চাইব, তখন চারটি বিষয় মাথায় রেখে আমাদের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিৎঃ পরিস্থিতি, হাতে থাকা সময় ও এনার্জির পরিমাণ এবং অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্যতা। আপনি যদি একটু সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করেন তাহলে দেখবেন এই চারটি বিষয়ই রোযাতে কিছুটা নাটকীয়ভাবে বদলে যায়।
যেহেতু এটা পবিত্রতম মাস যা অনেকগুলো আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে উপস্থিত হয় (ন্যুনতম যা করতে হয় তা হল ভোরবেলা সেহরির জন্য উঠা, রোযা রাখা, তারবীহ পড়া ইত্যাদি), তাই এটার অনুষঙ্গ সম্পূর্ণ আলাদা। রামাদ্বানে যা অর্জন করা যেতে পারে তা নিঃসন্দেহে অন্যান্য মাসের থেকে আলাদা (খেয়াল করে দেখবেন, আমি কিন্তু বলি নি যে অন্য মাসে কম!)
সন্ধ্যায় যেটুকু সময় হাতে পাওয়া যায় তা ইফতারের প্রস্তুতি,রোযা ভাঙা (যার সাথে প্রায়শই জড়িত থাকে দাওয়াত নেয়া বা দেয়া)এবং দীর্ঘ সময় ধরে তারাবীহর নামায পড়া, ইত্যাদি কারণে বেশ কমে যায়। রোযা রাখার ব্যাপারটি (সবসময় নয়) কিছুটা ক্লেশদায়ক হতে পারে, তাই এসময় আমাদের অন্যান্য মাসের মত কাজ করার এনার্জি থাকে না,অথবা অন্তত আর কিছু না হোক,আমাদের এনার্জি লেভেলের দৈনন্দিন ধাঁচটা বদলে যায়। আর যেহেতু এটা পবিত্রতম মাস, আমাদের অগ্রাধিকারগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়ে যায়, জাগতিক থেকে পারলৌকিক দিকে (এই বিষয়টি বুঝতে পারলে আধুনিক যুগের সময় ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত অনেক অনুযোগের সমাধান করা সম্ভব)
উপরোল্লেখিত বিষয়ের আলোকে, আমাদের কাজ যাই হোক না কেন, একটি বিশাল কোম্পানির ব্যবস্থাপক, ছাত্র, ব্যবসায়ী বা পেশাদার, আমাদের দৈনন্দিন উদ্দেশ্যগুলো সাধনের সাধারণ উপায় সম্পর্কে দ্বিতীয়বার চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু, প্রথমেই রামাদ্বানে আমাদের উদ্দেশ্যগুলো স্পষ্ট করে নেয়া দরকার।
রামাদ্বানের উদ্দেশ্য এবং আমাদের সময়ের উপর এর প্রভাবঃ
স্কলাররা যখন ইবাদাতের স্বরূপ নিয়ে আলোচনা করেন, তখন সাধারণত তারা একে দুই ভাগে ভাগ করেনঃ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ।আমরা সবাই জানি যে সকল কাজ, হোক তা থালাবাটি ধোয়া বা কর্মস্থলে ব্যস্ত থাকা, ইবাদাতে পরিণত করা যেতে পারে এক অমোঘ ঔষধ দ্বারা- তা হল নিয়্যত। তবে ইবাদাতের আরও অনেক রূপ আছে যেমন জিকির, সালাত এবং কুরআন তিলাওয়াত-যেগুলো প্রত্যক্ষ এবং এর সাথে কোনো পার্থিব সংশ্লিষ্টতা নেই। প্রত্যক্ষ ইবাদাত স্পষ্টতই শ্রেয়তর, যেহেতু এটা আধ্যাত্মিকভাবে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার শক্তিশালী মাধ্যম। সারাবছর ধরে আমাদেরকে খুব সামান্য কিছু প্রত্যক্ষ ইবাদাত করতে বলা হয়েছেঃ পাঁচ বেলা নামায, হাজ্জ এবং যাকাত, যা করতে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের খুব অল্প কিছু সময় ব্যয় হয়।
পক্ষান্তরে পরোক্ষ ইবাদাতে লিপ্ত হওয়ার অফুরন্ত সুযোগ রয়েছেঃ পরিবারের দেখাশোনা, জীবিকা অর্জন এবং সমাজসেবা।তবে রামাদ্বান প্রত্যক্ষ ইবাদাতের জন্য বিশেষভাবে নির্ধারিত। রামাদ্বানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তার সাহাবীদের অভ্যাসের দিকে সংক্ষিপ্ত দৃষ্টিপাত করলে এটাই প্রমাণিত হয়।
এই বিষয়টাই আমাদের সময়ে উভয় সংকটের সৃষ্টি করে। মুসলিম পেশাদাররা প্রায়ই দুশ্চিন্তাবোধ করেন এটা ভেবে যে কিভাবে তারা এই পবিত্র মাসে সর্বোত্তম উপায়ে কার্য সম্পাদন করতে পারেন। এক ধরণের হীনমন্যতার জন্ম নেয়,যেখানে অনেকেই তাদের ‘কার্যক্ষমতা হ্রাস’ পাওয়াতে লজ্জিত বোধ করেন। অফিস কর্মী, ছাত্র এবং প্রোজেক্ট কর্মীরা লজ্জিতভাবে ব্যাখ্যা করেন যে তারা সন্ধ্যায় খুব বেশি কাজ নিতে পারবেন না।
মুসলিম সংবাদপত্র গুলো তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার অধঃপতনে আক্ষেপ প্রকাশ করতে থাকে। এর প্রতিক্রিয়া স্বরূপ, নিজের স্বাস্থ্য এবং এনার্জি স্তর শীর্ষে নিয়ে যাওয়ার এক নেশায় চেপে বসে মুসলিমদের, যাতে তারা তাদের অমুসলিম সহকর্মী, যারা রোযা রাখছে না, তাদের সমকক্ষ হতে পারেন। তাই সাফল্য,প্রেরণা এবং কার্যকারিতা সংক্রান্ত আমার সকল পড়াশোনা দিয়ে আমি আমার পাঠকদের রামাদ্বানের ‘অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা’ সত্ত্বেও তাদের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে উদ্বুদ্ধ করে জনপ্রিয়তার গাড়িতে সমাসীন হতে পারতাম । কিন্তু আমি তা করব না, কারণ তাতে আমি আসল পয়েন্টটাই হারিয়ে ফেলব।
এই মাস আল্লাহকে প্রত্যক্ষভাবে ইবাদাত করার মাস। এটা মনঃ সংযোগ স্থাপন এবং রোযার উপকারিতা উপভোগ করার জন্য। এটা কুরআনের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি করার জন্য। এটা মসজিদে যাওয়ার জন্য এবং কুরআনের সুমধুর তিলাওয়াত শুনতে শুনতে জামাতে ২০ রাকাত নামায পড়ার সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য। আর তার মানে যদি হয় কম পার্থিব যশ, তবে তাই হোক! কারো ঊর্ধ্বতনকে যদি শান্তভাবে এই মাসের পবিত্রতা ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলতে হয় যে আপনি বেশি কাজ করতে পারবেন না, তবে তাতে বিন্দুমাত্র লজ্জিত হবার কিছু নেই। এ ব্যাপারে আপনাকেই অগ্রবর্তী হতে হবে। আগে থেকেই কিছুদিন ছুটি নিয়ে নিন,কিছু কাজ অধঃস্তনদের করতে দিয়ে দিন, কিংবা তোমার রুটিনকে এমনভাবে পুনর্বিন্যাস করুন যাতে সপ্তাহান্তে বেশি বেশি কাজ করতে পারেন।
যখন আপনি বুঝতে পারবেন যে রামাদ্বানে অগ্রাধিকার পাবে ইবাদাত, সবকিছু সেই অনুযায়ী ঠিকঠাকভাবে বিন্যস্ত হয়ে যাবে। একজন বিবাহিত মহিলার কথা চিন্তা করুন, যিনি ঘরে থেকে কয়েকজন বাচ্চার দেখাশোনা করেন।তার স্বামী যদি মারা যান,তাহলে হঠাৎ করেই তাকে এখনকার স্কুলে ছোটাছুটি,ঘরের কাজ এবং মাতৃত্বজনিত অন্যান্য কাজের সাথে সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা কাজের প্রতিশ্রুতিসহ চাকুরী নিতে হবে। তার বর্তমান ব্যস্ত জীবনযাত্রার মাঝে চাকুরী করার কথা তিনি দূরতম স্বপ্নেও চিন্তা করেন নি। কিন্তু তার স্বামী মারা গেছেন।তার আর কোনো বিকল্প নেই। তাকে কাজটা করতেই হবে। তাই ঊনি এখন কাজ করেন স্বউদ্যোগে।একটা উপায় বের করেছেনঃ একজন আয়া রেখেছেন; তার কাজগুলোকে গ্রুপে ভাগ করে নিয়েছে্ন; সময় নষ্টকারী কাজগুলো বাদ দিয়েছেন। স্বউদ্যোগী হওয়ার মাধ্যমে সে তার কার্যকারিতা ২০০% এ উন্নীত করেছে। বাস্তব জীবনেও সারা দুনিয়াতে এরকম অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।
এই উদাহরণ থেকে যেটা বোঝা যায় তা হল, যেমনটা ডঃ শোয়ার্টজ তার অতুলনীয় ‘ উচ্চাভিলাষী হবার জাদুকরী কৌশল’ তে ব্যাখ্যা করেছেন, “যোগ্যতা আসলে একটা মানসিক বিষয়।যখন আপনি সত্যিকার অর্থে বিশ্বাস করেন যে আপনি অনেক বেশি কিছু করতে পারেন,আপনার মন তখন সৃষ্টিশীলভাবে চিন্তা করতে থাকে এবং আপনাকে পথ দেখায়”। এভাবে রামাদ্বানে আমরা যদি ইবাদাতকে আমাদের কেন্দ্রবিন্দু বানাই, আমাদের সময়ে বরকত দেয়ার জন্য আল্লাহ্র কাছে দুআ করি এবং সত্যিকারে বিশ্বাস করি যে আমাদের যা যা করা দরকার তা আমরা করতে পারবো-তাহলে কিভাবে সবকিছু সাজাতে হবে সেটার উপায় সহজেই মাথায় চলে আসবে।
আপনি যদি রামাদ্বানের উদ্দেশ্যের ব্যাপারে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গী,এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করে থাকেন- তাহলেই আপনি এই প্রবন্ধের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষাটি বুঝতে পারবেন। এই মূল বাণীর তুলনায় আর সব কৌশলগুলো হচ্ছে শাখা বিশেষ। কেউ যদি ভালো মুসলিম হতে চায় এবং এখান ওখান থেকে একটা দুটো ভালো কাজ শিখে, সে কিভাবে তুলনীয় হতে পারে তার সাথে যে তাকওয়া এবং আল্লাহ্র আনুগত্যকে এই সব কিছুর ভিত্তি হিসেবে নিয়েছে? পরের জন দৃষ্টি নিবদ্ধ করছে একটি মানসিকতার উপর এবং এটা তার উন্নতির গতিকে অনেক বেগবান করবে সেই মুসলিমের থেকে যে দৃষ্টি নিবদ্ধ করছে কিছু বিচ্ছিন্ন কাজের উপর। অনুরূপভাবে আপনি যদি রামাদ্বানকে একজনের প্রত্যক্ষ ইবাদাত বাড়ানোর একটা প্রোজেক্ট হিসেবে নেয়ার ইচ্ছা পোষণ করো এবং এ ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন, তাহলে অন্য তেমন কিছু করা ছাড়াই আপনি যথেষ্ট আগাতে পারবেন।
তবে কিছু কৌশল আছে যা আপনাকে সময়ের সর্বোত্তম ব্যবহার করতে সাহায্য করবে, সঠিক দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করার পরও। আর এই বিষয়টা আমাদের এই প্রবন্ধের দ্বিতীয় পর্বে আলোচনা করা হবে।
No comments:
Post a Comment