আমার ক্ষিপ্ত মুসলিম যুবক ভাইদের প্রতি

প্রবন্ধটি পড়া হলে, শেয়ার করতে ভুলবেন না


রহমান রহীম আল্লাহ্‌ তায়ালার নামে-

উস্তাদ নুমান আলী খান প্রকাশনায় : http://alquranerallo.blogspot.com
মহানবী (সাঃ) কে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক চলচ্চিত্র নির্মাণ ও ইউটিউবে সেটার ভিডিও প্রকাশের প্রতিক্রিয়ায় যখন সমগ্র মুসলিম বিশ্ব উত্তপ্ত, তখন উস্তাদ নুমান আলী খান আমেরিকার একটি মসজিদে মুসলিম যুবক ভাইদেরকে উদ্দেশ্য করে এই খুৎবা প্রদান করেন। খুৎবার অনুলিপিপ্রবন্ধাকারে উপস্থাপন করা হল। মূল বক্তৃতা ও অনুলিপিতে সামান্য কিছু পার্থক্য থাকতে পারে। আশা করি পাঠকবৃন্দ সেই ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। 
(আল্লাহর কাছে দোয়া প্রার্থনা, রাসুল ও নবীগনের প্রতি সালাম জানিয়ে তিনি এই খুৎবা আরম্ভ করেন।)
আসসালামু আলাইকুম, আজ আমার ভেতরে এক মিশ্র অনুভূতি কাজ করছে। একদিকে আমি এই এলাকায় ফিরে আসতে পারায় আনন্দিত। সেই চেনা মুখগুলো আবার দেখার সুযোগ পাওয়ায় সত্যি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ বোধ করছি। আর আল্লাহর কাছে দোয়া করি যেন আমার এই সফর তিনি কবুল করেন এবং আমার ও আপনাদের সবার জন্য কল্যাণকর করেন। অন্যদিকে আমাদের মুসলমানদের জন্য এটা একটা কষ্টকর ও সংকটময় সময়। কয়েক সপ্তাহ পর পরই এমন কিছু ঘটনা ঘটে যাচ্ছে যা আমাদের সবার মনকে আঁধার কালো করে দিচ্ছে। আমাদের সবাইকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। আর এখন তেমনই একটা সময় চলছে। আপনারা যারা নিয়মিত বিশ্বের খবরাখবর রাখেন, তারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমি কি বিষয়ে কথা বলতে যাচ্ছি। আপনারা অবশ্যই জানেন একটি অত্যন্ত নিম্নমানের জ্বালাময়ী ভিডিওর প্রতিবাদে পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রে ঘটে যাওয়া বিক্ষোভের কথা। যদিও কুরআনের দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রসঙ্গেই আমার আজকের খুৎবার বিষয়ের অবতারণা; আমি শুরুতেই একটি কথা জানাতে চাই যে, যতদিন পর্যন্ত না মুসলমানরা এই ভিডিওটির প্রতি মনোযোগ দেওয়া শুরু করে, এই বিশেষ ভিডিওটির ৩০ টিও হিট সংখ্যা ছিল না। আর এরপর ব্যপারটি এমনই দিকে গড়িয়েছে যে, আমরা মুসলমানরাই এই কুরুচিপূর্ণ, বাজে, নিম্নমানের ফিল্মটির  সবচেয়ে বড় অ্যাডভারটাইজিং এজেন্সি হিসেবে কাজ করছি। আর কেউ না, বরং আমরা নিজেরাই দুনিয়া জুড়ে এর প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি। এর আগে কেউ এর দিকে লক্ষ্যও করেনি।
 যাই হোক, আজকের খুৎবা আমি আমার ক্ষিপ্ত যুবক মুসলমান ভাইদেরকে উৎসর্গ করছি। আপনারা যদি ইতিমধ্যেই না জেনে থাকেন, জেনে রাখুন এই মুহূর্তে পৃথিবীতে জীবিত সমস্ত মুসলমান জনগোষ্ঠীর ৬২% মানুষের বয়স ৩০ বা এর নিচে। এই উম্মাহর একটি বিশাল অংশই যুবসমাজের। তাই, এই ক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদমুখর মুহূর্তে আমার আজকের এই খুৎবা আমার সেই সব মুসলিম ক্ষুব্ধ যুবক ভাইদেরকে উৎসর্গ করতে চাই। আমার সেই সব ভাইদেরকে যারা মনে করে, যখন আল্লাহর রাসুল (সাঃ) অপমানিত হন, তখন তারাও অপমানিত হন, এবং এই জন্য তাদের কিছু একটা করা উচিত। তাদের রক্ত রাগে টগবগিয়ে উঠে যখন আল্লাহর রাসুল (সাঃ) এর সম্পর্কে এমন অবমাননাকর কিছু বলা হয়। আমাদের নবী (সাঃ) এর সামান্যতম অপমানও আমাদের সমস্ত সুখ, আনন্দ কেড়ে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট; কারণ তাঁর প্রতি আমাদের ভালবাসা এতই তীব্র।
অন্য ধর্মের মানুষ প্রশ্ন করে- মুসলমানেরা কেন এত্ত ক্ষ্যাপা? যখন কেউ আমাদের যীশু খ্রিস্ট কে নিয়ে ঠাট্টা করে টিভি তে অনুষ্ঠান করে, কই আমরা খৃস্টানরা তো ক্ষেপে উঠি না ! মুসা কে নিয়ে তো অহরহ ঠাট্টা কৌতুক হয়, কই ইহুদিরা তো ক্ষেপে উঠে না ! হিন্দু ধর্ম নিয়ে তো সবসময়ই হাসি তামাশা করা হয়, কই হিন্দুরা তো ক্ষেপে ওঠে না ! তোমাদের মুসলমানদের সমস্যাটা কোথায়, তোমাদের নিয়ে কিচ্ছু বলা যায় না? তোমাদের কি বাক স্বাধীনতা বলতে কোন কিছু সম্পর্কে ধারণা নেই? তোমরা এত ক্ষেপে যাও কেন?
আর আমাদের উত্তর থাকে (এবং আপনারা হয়তো ভাবতে পারেন আজকের খুৎবায় আমারও এই প্রশ্নের উত্তর বুঝি এই যে) – ‘তোমরা জানো না ভালবাসা কাকে বলে, তোমরা জানো না। তোমরা মনে কর তোমরা যীশুকে ভালোবাসো; কিন্তু আমাদের রাসুল (সাঃ) এর প্রতি ভালোবাসা তাঁর চেয়ে অনেক অনেক অনেক বেশী; এই কারণেই আমরা ক্ষেপে উঠি।’ কিন্তু এটা আমার আজকের উত্তর নয়।
যখন আমাকে প্রথমে প্রশ্নটা করা হয়, আমার জবাব হল- এটা কিভাবে সম্ভব যে যখন ঈসা (আঃ) কে নিয়ে ঠাট্টা করা হয়, তখন আমার রাগ হবে না? যখন মুসা (আঃ)কে নিয়ে তামাশা করা হয়, আমি রেগে উঠি না? মুসা (আঃ) হলেন সেই নবী যার কথা কুরআনে সবচেয়ে বেশী বার নাম ধরে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘মুহাম্মাদ’ নামটি চারবার, আর ‘আহমাদ’ নামটি একবার উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের মহানবী (সাঃ) কে কয়েকবারই নাম ধরে কুরআনে ডাকা হয়েছে। আর মুসা (আঃ)কে সত্তর বারেরও বেশী উল্লেখ করা হয়েছে। যখন মুসা (আঃ)কে খোঁচা দিয়ে ঠাট্টা করা হয়, তখন অনেক অনেক বেশী করা করা হয়। যখন ঈসা (আঃ) কে নিয়ে বিদ্রুপ করা হয়, তখনও অনেক অনেক বেশী করে করা হয়। তখন কোথায় থাকে আমাদের রাগ? ‘ওহ, ওটা ইহুদী খ্রিস্টানদের সমস্যা ।'এটা কি ‘ওদের’ সমস্যা? আমাদের সমস্যা না? কাজেই, প্রথমত আমরা যেভাবে আমাদের মানসিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করি, সেটাতেই আমাদের বড় ত্রুটি রয়ে গেছে। আমরা কোন কিছুকে অপমানজনক সমস্যা বলে সনাক্ত করার আগেই আমাদের ভেতরেই এখনো যথেষ্ট সমস্যা রয়ে গেছে। আপনারা বলতে পারেন- কিন্তু না না না, আল্লাহ রাসুল (সাঃ) কে বিশেষ সম্মান দিয়েছেন। আমি স্বীকার করি, অবশ্যই আল্লাহ হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)কে বিশেষ সম্মান দিয়েছেন। কিন্তু আল্লাহই কুরআনে বলেছেন-
 سُبْحَانَ رَبِّكَ رَبِّ الْعِزَّةِ عَمَّا يَصِفُونَ ۞
وَسَلَامٌ عَلَى الْمُرْسَلِينَ ۞
 “তারা যা আরোপ করে তা হতে পবিত্র ও মহান তোমার প্রতিপালক, যিনি সকল ইজ্জত- ক্ষমতার অধিকারী। আর শান্তি বর্ষিত হোক রাসুলদের উপর।” [সূরা আস-সাফফাত ১৮০-১৮১]
আল্লাহই বলেছেন- শান্তি বর্ষিত হোক রাসুলদের উপর।
 ক্ষিপ্ত মুসলমান যুবক ভাইয়েরা আমার, বক্তব্যের শুরুতে একটা কথা মনে করিয়ে দিতে চাই। আমাদের রাসুল (সাঃ) এর সম্মান, আভিজাত্য, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, মর্যাদা-এর কোন কিছুই আমরা তাঁকে দেই নি; এসব কোন মানুষের দেওয়া জিনিস নয়। এসব সেই উপরের আকাশ থেকে এসেছে। এসব আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে। পৃথিবীর কেউ এসব কেড়ে নিতে পারেনা। কুরআন এসেছে সেই আকাশ থেকে। মানুষ এর কপি পোড়াতে পারে, বিদ্রুপ করতে পারে, ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করতে পারে; কিন্তু এতে কোরআনের মর্যাদা কোন অংশে কমে যাবে না। কারণ কুরআন আছে লাওহে মাহফুজ এ। এর মর্যাদাহানি করা যায় না। এটা এ সব কিছুর ঊর্ধ্বে।
 আমাদের রাসুল (সাঃ) এর সম্মান এর সব কিছুর ঊর্ধ্বে। সূরা ইসরা তে আল্লাহ সুবহানা ওয়াতা’য়ালা তাঁর রাসুল (সাঃ) কে মাকামে মাহমুদ বা সর্বোচ্চ সম্মানিত স্থান দিয়েছেন। আল্লাহ দিয়েছেন, কোন মানুষ দেয়নি। আর এই কারনেই আপনাদের ক্ষুব্ধ হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। যারা আল্লাহর রাসুল (সাঃ)কে অপমান করে কথা বলে আপনি তাদের উপর ক্ষিপ্ত হবেন না। আপনি তাদের জন্য করুণা করুন। আমাদের তাদের জন্য আফসোস বোধ করা উচিত, কতই না হতভাগা তারা! তারা  আমাদের মহানবী (সাঃ)এর কোন ক্ষতি করতে পারে না। তারা আমাদের দ্বীনেরও কোন ক্ষতিসাধন করতে পারে না। তারা শুধু নিজেদের ক্ষতিই করছে। কিন্তু আজকের খুৎবায় আমি আরও কিছু বলতে চাই। আজ আমি ক্ষুব্ধ, সত্যিই ক্ষুব্ধ। কিন্তু আমি আজ ক্ষুব্ধ আমার যুবক মুসলমান ভাইদের প্রতি। আপনারা আল্লাহর দ্বীনকে রক্ষা করতে চান? তাঁর রাসুল (সাঃ)এর সম্মান রক্ষা করতে চান? তাহলে আগে তাঁর সম্পর্কে জানুন। যারা আল্লাহর রাসুল (সাঃ) এর মুখের উপর সরাসরি থুথু নিক্ষেপ করেছে তাদের চেয়ে বেশী আর কে তাঁকে অপমান করেছে বলুন? আর যারা তাঁকে সরাসরি মুখের উপর অভিশাপ দিয়েছে তাদের চেয়ে বেশী? আর তখন প্রতিটি দিন তারা তাঁকে সরাসরি নানান অপমানজনক নাম ধরে ডেকেছে। আর সেই অপমানগুলো কে সয়েছে? শুধু আল্লাহর রাসুল (সাঃ) না, তাঁকে নানা ভাবে অপমানিত হতে দেখছে শুনেছে তাঁরই সঙ্গে থাকা সাহাবাগণ (রাঃ)। এসব কিছু দিয়ে আল্লাহ আপনাকে, আমাকে একটা ব্যপারের জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত করতে চেয়েছেন। আর সেটি হল, আমরা যেমন আমাদের মহানবী (সাঃ) কে ভালবাসি, সম্মান দেই, শ্রদ্ধা করি, ঠিক তেমনি আপনাকে এই বিষয়টিও জেনে রাখতে হবে যে, কিছু মানুষ নবী রাসুলদের কে ঘৃণাও করবে। এতটাই ঘৃণা যে তারা নবী রাসুল দের অপমানও করবে। তারা নবী রাসুলদের কে নিয়ে পীড়াদায়ক, কুৎসিত, জঘন্য কথাও বলেছে, বলবে। আর সেই সব অপমানজনক কথাগুলো আমরা আজও কুরআনে বিশুদ্ধতম উচ্চারণে সুর করে তেলাওয়াত করি।
 وَيَقُولُونَ إِنَّهُ لَمَجْنُون
 “এবং তারা বলেঃ সে তো এক পাগল” (সূরা ক্বালামঃ ৫১)
 سَاحِرٌ كَذَّابٌ
 “এ তো এক জাদুকর, চরম মিথ্যাবাদী” (সূরা মু’মিন/গাফিরঃ ২৪)
 এই সব আমাদের মহানবী (সাঃ) ও অন্যান্য নবী রাসুলগণকে (আঃ) বলা অপমানজনক কথা। কিন্তু আল্লাহ এই সব কথাও কুরআনে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। আমরা সেগুলোকে সুর করে বিশুদ্ধতম উচ্চারণে তেলাওয়াত করি। কাজেই জেনে রাখুন, এটা নতুন কোন ঘটনা না – ‘কত বড় স্পর্ধা তারা আমাদের নবী (সাঃ) কে অপমান করে!’। আপনি কি বলতে চান? এসব তো সেই প্রথম থেকেই ঘটে আসছে। আপনি তাহলে কোন কুরআন পড়েন? আর তখন সেই সব সাহাবাগণ কি করেছিলেন? তারা কিভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন? একটা বিখ্যাত হাদীসের কথা আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই, যা বেশ কয়েকটি বর্ণনায় এসেছে। একদিন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ও আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) একসাথে বসেছিলেন। কিছু লোক এসে আবু বকর (রাঃ)কে অপমান করা শুরু করল। অন্য এক বর্ণনায়, তারা আবু বকর (রাঃ) কে একবার নয়, দুইবার নয়, তিনবার অপদস্থ করল। তৃতীয়বারের সময় আবু বকর (রাঃ) উঠে দাঁড়ালেন, তিনি আর সহ্য করতে পারছিলেন না। কারণ তারা শুধু তাঁকেই অপমান করছিল না, তাঁর পরিবার, তাঁর মা, তাঁর বোন, তাঁর মেয়েদের নিয়েও অপমানজনক কথা বলছিল। জানেন তো ঐ লোকদের চরিত্র, তাদের মধ্যে কোন শ্রদ্ধাবোধ ছিল না। অন্য আরেকটি বর্ণনায় বলা আছে, তিনি তখনও বসে রইলেন। উঠলেন না।  লোকগুলি যখন ভাবল, এর তো কিছুই হচ্ছেনা, এর যথেষ্ট ধৈর্য। আমরা যদি এর নবীকে অপমান করে কথা বলি তাহলে অবশ্যই সে রেগে উঠবে। তাই তারা মহানবী (সাঃ) কে আবু বকর (রাঃ) এর সামনে অভিশাপ দিতে শুরু করল। আপনি আর আমি আল্লাহর রাসুল (সাঃ) কে ভালবাসি। কিন্তু আমরা কখনো তা আবু বকর (রাঃ) এর ভালবাসার সাথে তুলনা করতে যাবো না। কখনই না। আবু বকর (রাঃ) তখন মহানবী (সাঃ) এর অপমান আর সইতে পারলেন না। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তিনি উঠে দাঁড়ানোর পর রাসুল (সাঃ)ও উঠে গেলেন। যে মুহূর্তে আবু বকর (রাঃ) উঠে দাঁড়ালেন, মহানবী (সাঃ)ও উঠে অন্য দিকে চলে গেলেন। এখন আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) দ্বিধায় পরে গেলেন, তিনি কি সেই লোকদের দিকে ফিরে উত্তর দেবেন, সেই আহাম্মকদের দিকে, নাকি তাঁর রাসুল (সাঃ)এর পেছনে যাবেন। তিনি আল্লাহর রাসুল (সাঃ) এর পেছন পেছন গেলেন। আর জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি ভুল কিছু বলেছি? আমি কি কোন ভুল করে ফেলেছি? এই বর্ণনার কয়েকটি সংস্করণ আছে। রাসুল (সাঃ) বললেন- ‘তুমি যতক্ষণ বসে ছিলে, ফেরেশতারা আমাদের ঘিরে রেখেছিল। যেই মুহূর্তে তুমি রেগে গিয়ে উঠে দাঁড়ালে, ফেরেশতারা সেখান থেকে চলে গেল আর শয়তান এসে হাজির হল। আর যেখানে ফেরেশতারা থাকে না, সেখানে আমিও থাকি না।’ মহানবী (সাঃ) এর উত্তর ছিল এটা। রাসুল (সাঃ) এভাবে তাঁর সাহাবাগণ কে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন - যখন আমাকে অপমান করা হয়, এভাবে আচরন কর। ধৈর্যশীল হও, ধৈর্যশীল হও।
আমার তায়েফের ঘটনাটি মনে পড়ছে। তায়েফবাসীরা মহানবী (সাঃ) শুধু কথা দিয়েই কষ্ট দেয়নি; তারা প্রায় তাঁকে মেরেই ফেলেছিল। তারা পাথর ছুঁড়ে মারছিল, রাস্তার মাস্তানদেরকে পেছনে লেলিয়ে দিয়েছিল। রাসুল (সাঃ)এর পেছনে পেছনে ধাওয়া করছিল, পাথর ছুঁড়ে আঘাত করছিল। এদিকে রাসুল (সাঃ) এর ক্ষত বিক্ষত শরীর থেকে যখন রক্ত ঝরছিল, তিনি সেই রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই হাত দিয়ে তুলে ফেলছিলেন, কারণ তিনি জানতেন, তাঁর রক্ত মাটিতে পড়লে আল্লাহর গযব নেমে আসবে। তিনি চাননি যে এই মাটি সাক্ষ্য দিক যে তারা কোন নবীর রক্ত ঝরিয়েছে। রসুল (সাঃ) নিজেকে নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না, তিনি চিন্তিত ছিলেন সেই লোকদের জন্য, তাদের জন্য তিনি নিজের রক্ত মাটিতে ঝরার আগেই ধরে ফেলছিলেন। আর শেষ পর্যন্ত যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল এই জনপদকে গজবে ধ্বংস করে দেওয়া হবে কিনা, তিনি বললেন- না, হয়তো এদের মধ্য থেকে এমন সন্তান সন্ততি, বংশধর জন্মাবে যারা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে। এবং আপনারা কি জানেন- রাসুল (সাঃ) এর ইন্তেকালের পরে, মুসলিম উম্মাহ একটি বিশৃঙ্খল সময় পার করছিল যখন কিছু মানুষ ইসলাম কে সমর্থন করছিল, কিছু মানুষ সমর্থন করছিল না; শুধুমাত্র দুইটি জনপদেরর মানুষ এই দুঃসময়েও ইসলামকে দৃঢ় ভাবে আঁকড়ে রেখেছিল – মক্কাবাসীরা ও তায়েফবাসীরা। আবু বকর সিদ্দীকের খিলাফতের সময় ইসলামকে সুদৃঢ় রাখার ব্যপারে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছিল এই তায়েফবাসীরাই; যা সেই সঙ্কট মুহূর্তে খুবই জরুরী ছিল। সেই তায়েফ এরই অধবাসীরা যারা এক সময় রসুল (সাঃ) কে প্রায় মেরেই ফেলছিল। রাসুল (সাঃ) তাদের উপর ক্ষিপ্ত হননি, তিনি তাদের জন্য আফসোস করেছেন। তাই তিনি তাদের জন্য দোয়া করেছেন। আজ তাদের প্রতি আমার মনোভাবও এটাই। যেই উম্মতের মধ্যে দয়া ও করুণা বিরাজমান তাদের মনোভাব হবে এই রকম। এটাই রাসুল (সাঃ) মনোভাব ও প্রতিক্রিয়া যখন বার বার আবু জেহেল তাঁকে অপমান করেছে। তারপরও তিনি দোয়া করে গেছেন, সুবহানাল্লাহ!
এই প্রসঙ্গে আরও একটা বিষয় আপনাদেরকে জানাতে চাই। মহানবী (সাঃ)কে এই বিষয়ে এভাবে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে যে- আপনি রেগে যাবেন না। আল্লাহ তা’য়ালা কুরআনে বার বার করে তাঁকে বলেছেন- যখন তারা অপমান করে, আপনি রেগে যাবেন না।
فَإِن كَذَّبُوكَ فَقَدْ كُذِّبَ رُسُلٌ مِّن قَبْلِكَ
 “অতঃপর যদি তারা তোমার প্রতি অসত্যারোপ করে, তবে তোমার পূর্বেও রাসুলগণকে অবিশ্বাস করা হয়েছিলো...”[সূরা আল ইমরানঃ ১৮৪]
আল্লাহ বলছেন, তারা আপনার প্রতি মিথ্যারোপ করেছে, অন্যান্য রসুলগণের বিরুদ্ধেও মিথ্যারোপ করা হয়েছিল; এমন ঘটনা এটাই প্রথম নয়।
 وَاصْبِرْ عَلَىٰ مَا يَقُولُونَ وَاهْجُرْهُمْ هَجْرًا جَمِيلًا
“লোকেরা যাই বলে, তাতে তুমি ধৈর্য ধারণ কর এবং উত্তম পন্থায় তাদেরকে পরিহার কর।” [সূরা মুজাম্মিলঃ ১০]
 ‘মা ইয়া ক্বূলূন’ আরবীতে একটি খুব শক্তিশালী কথা; যার অর্থ ‘যা কিছুই তারা বলুক ।' ভাষাবিদরা বলেন, এখানে ‘মা’ শব্দটি একটি অনিশ্চয়তা বোধক শব্দ। এখানে ‘মা’ এর পরিবর্তে যদি ‘আল্লাযী’ বলা হত তাহলে তা অনেক সুনির্দিষ্ট করে কিছুকে নির্দেশ করত। কাজেই যদি আয়াতটিতে কাফিরদের বলা কোন নির্দিষ্ট একটি কথার জবাবে ধৈর্য ধারণ করার কথা বলা হত তাহলে আয়াত টি হত- “ওয়াসবির ‘আলা আল্লাযী ইয়া ক্বূলূনা...।" কিন্তু এখানে বলা হয়েছে, “ওয়াসবির ‘আলা মা ইয়া ক্বূলূনা...” অর্থাৎ ‘তারা যা-কিছুই বলুক।' আজ তারা আপনাকে একটা কিছু বলে অপমান করছে, কাল অন্য কিছু বলবে; কিচ্ছু আসে যায় না, আপনি ধৈর্য ধারণ করুন। এবং এই আয়াতে বর্তমান কাল ও ভবিষ্যৎ কাল দুইটাই বিদ্যমান। কাজেই, লোকেরা আজ যা কিছু বলছে, এবং কাল যা কিছুই বলুক, আপনি চিন্তিত হবেন না। আর লোকেরা শুধু রাসুল (সাঃ) কে অপমান করেই ক্ষান্ত হয়নি। আমরা জানি, যখন রাসুল (সাঃ) হিজরত করে মদিনায় গেছেন, তাঁর পরিবারকে নিয়েও অবমাননাকর কথা বলা হয়, মা আয়েশা (রাঃ) এর বিরুদ্ধেও অপমানজনক কথা রটানো হয়। কুরআনে এরকম অসংখ্য ঘটনার উল্লেখ আছে যেখানে বলা হয়েছে কিভাবে রাসুল (সাঃ) কে কাফিররা এমনকি মুসলমানবেশী মুনাফিকরাও অপমান অপদস্থ করেছে। দুনিয়াবী কোন কিছু লাভের আশা নবী রাসুলগণের মধ্যে নেই। কিন্তু মুনাফিকেরা এই বলে রাসুল (সাঃ) এর অপমান করেছে- তিনি যুদ্ধ করেন যাতে বেশী বেশী সম্পদ পেতে পারেন। মুনাফিকেরা অপমান করেছে। মুশরিক, কাফেররা অপমান করেছে। রাসুল (সাঃ) এর পরিবারকেও অপমান করেছে। তখন কোন প্রতিবাদ হয়েছিলো? মদিনার সাহাবাগণ, মুহাজির ও আনসারগণ – তাঁরা কি রাসুল (সাঃ) কে ভালোবাসতেন না? তাঁরা কি এইসব অপমান দেখেননি? তাঁরা কোন বাড়ি ঘরে আগুন লাগিয়েছিল? তাঁরা কোন গাড়ি মাড়িয়েছিল? তাঁরা কি রাস্তার কোন অমুসলিমকে দেখে বলেছিল- ঐ যে একজন ইহুদীকে দেখছি। ইহুদীরা অপমানজনক কথা বলেছে, চল ওকে মেরে ফেলি, একজন ইহুদীকে পেয়েছি।
 আমাদের কি হয়েছে? কি হয়ে গেছি আমরা? আপনারা এটাকে দ্বীনকে রক্ষা করা বলেন? আমি আপনাদের মতো ক্ষিপ্ত নই। আপনারা যদি এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে থাকেন, তাহলে আপনারা কুরআন ঠিক মতো পড়েননি। আপনারা যদি এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে থাকেন, তাহলে আপনারা রাসুল (সাঃ) কে জানেননি। আপনারা সাহাবাগণকে চেনেন না, আপনারা এই মানুষগুলোর আদর্শ সম্পর্কে অজ্ঞ। কি নিয়ে আপনাদের এত ক্ষোভ? এটা খুবই বেদনাদায়ক!
 ক্রোধ নিয়েই আমাদের সবার জন্য একটা বিষয় পরিষ্কার করে বলতে চাই। একটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখাতে চাই বিষয়টা। যখন আল্লাহর রাসুল (সাঃ)এর অবমাননা করা হয়, তখন আল্লাহ বলেন, এটা আপনার অপমান নয়। ওরা আপনাকে বিদ্রুপ করছে না। ওরা অন্যায় করছে, ওরা আল্লাহর আয়াতকে অস্বীকার করছে। ওরা রাসুল হিসেবে আপনাকে অপমান করছে। আপনি কুরআন নিজ থেকে নিয়ে আসেননি, আপনি অপমানিত হবেন না। আপনি নিজে নিজে রাসুল হননি, আপনি নিজে থেকে সিদ্ধান্ত নেন নি যে আপনি একদিন রাসুল হবেন; আমি আপনাকে রাসুল হিসেবে নির্বাচন করেছি, আমি আপনাকে কুরআন দিয়েছি; কাজেই ক্রুদ্ধ হওয়ার অধিকার আমার, আপনি ক্রুদ্ধ হবেন না; এরা আমাকে অপমান করছে। ক্রোধ কে আল্লাহ নিজের করে নিয়েছেন। ক্রুদ্ধ হওয়া আল্লাহ সুবহানা ওয়াতা‘আলাকেই সাজে। আমার কিছু যুবক ভাই ভাবতে পারেন, যা আল্লাহ কে রাগিয়ে দেয়, তাতে আমাদেরও রেগে যাওয়া উচিত। তাহলে আপনাদের আরেকটু বুঝিয়ে বলি। একটি ছোট্ট উদাহরন দেই। আমরা যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছি; আমরা মুলতঃ খৃস্টান জনগোষ্ঠী দিয়ে পরিবেষ্টিত। আমরা কুরআনে পাই, আল্লাহ বলেন-
“তারা বলে- করুনাময় আল্লাহ সন্তান গ্রহন করেছেন। তোমরা তো এক বীভৎস কথার অবতারণা করেছ। এতে যেন আকাশসমূহ বিদীর্ণ হয়ে যাবে, পৃথিবী খণ্ডবিখণ্ড হবে ও পর্বতসমূহ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে আপতিত হবে। যেহেতু তারা দয়াময়ের উপর সন্তান আরোপ করে।” [সূরা মারইয়ামঃ ৮৮-৯১]
 এখন কল্পনা করুন, এই বিল্ডিং এর ঠিক বাইরে একটি গির্জায় একজন লোক বলছে- আল্লাহর পুত্র আছে। আপনি কি কথাটি শুনতে পারবেন? না। কথার আওয়াজ কি দেওয়াল ভেদ করে আপনাদের কানে আসবে? না। আল্লাহ বলেন, প্রতিবার যখন এধরনের কথা উচ্চারিত হয়, এই আওয়াজ সমস্ত আকাশ মণ্ডলী ও পৃথিবীতে পৌঁছে যায়। সমগ্র সৌরজগৎ তা শুনতে পায়। এবং তা প্রায় বিদীর্ণ হয়ে যায়, খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যেতে চায়। এই সমগ্র বিশ্ব চরাচর তা সহ্য করতে পারে না। এটা প্রায় ধ্বংস হয়ে যেতে চায়। আল্লাহর সমস্ত সৃষ্টি তখন এতটাই অপমানিত হয় যখন বলা হয় আল্লাহ সন্তান গ্রহন করেছেন। আমরা তা শুনি না। কিন্তু গায়েবের জগতে সমস্ত আকাশ মণ্ডলী ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়। আল্লাহর কাছে এটা এতটাই অপমানজনক যখন কেউ বলে আল্লাহ সন্তান গ্রহন করেছে। এমন হল আল্লাহর ক্রোধ। এখন এই ক্রোধের কথাটি মাথায় রাখুন। একবার খ্রিস্টানদের একটি দল রাসুল (সাঃ) এর সাথে মদীনায় দেখা করতে এলো; তারা শুনেছে যে তিনি নাকি একজন রাসুল, এবং তিনি সেই রসুল যার কথা আগে তাদের কিতাবে বলা আছে। তাই তারা আমাদের রাসুল (সাঃ)কে দেখতে এলো। আর এই ঘটনাটি যেই সময়ের, সেই সময় এই লোকগুলো ঈসা (সাঃ) এর উপাসনা করত। আর আপনারা জানেন, সেই সময় কোন ‘হলিডে ইন’, ‘হিলটন’ বা ‘শেরাটন হোটেল’ ছিল না। তাহলে এই খৃস্টান লোকগুলো কোথায় উঠবে? তারা ছিল খৃস্টান পাদ্রী, বিশপ, তাদের ধর্মের বিশিষ্ট প্রতিনিধিদল এরা। খৃস্টান ধর্মের রাজদূত এরা। কোথায় থাকবে তারা? রাসুল (সাঃ) সিদ্ধান্ত নিলেন, এরামসজিদে-এ-নববী তে থাকবে। এরা কোথায় উপাসনা করবে? এরা উপাসনা করবে মসজিদে-এ-নববীতে, রাসুল (সাঃ) এর মসজিদে। এরা ইসলামের প্রথম শিক্ষাঙ্গনে এদের উপাসনা করবে। সেই স্থানে যেখানে ইসলামের শিক্ষা দেয়া হয়, তারই মাঝে এরা উপাসনা করবে। মদীনায় তাওহীদ প্রচারের কেন্দ্রবিন্দুতে একদল লোক থাকবে এবং যীশু খৃষ্টকে রব বলে ডাকবে। আল্লাহ কি এতে খুশী হবেন না ক্রুদ্ধ হবেন? অত্যন্ত ক্রুদ্ধ। কিন্তু কার এখানে বিচলিত না হয়ে বরং নরম, নমনীয়, সৌজন্যবোধ সম্পন্ন, মহানুভব আচরণ করার কথা? রাসুল (সাঃ) এর। ক্রুদ্ধ হওয়ার অধিকার আল্লাহর আছে। আপনার এবং আমার নেই। আল্লাহ আপনার এবং আমার প্রভু। তাঁর অধিকার আছে তাঁর দাসদের উপর ক্রুদ্ধ হওয়ার। অন্য আরেকজন মানুষ তো আমার দাস নয়। সে আল্লাহর দাস। আমার যদি কিছু করার অনুমোদন থাকে, তা হলো বড়জোর আমি চিন্তিত হতে পারি, আফসোস করতে পারি। আল্লাহ কখনও তাঁর রাসূল (সাঃ) কে বলেননি- আপনি তাদের উপর ক্রুদ্ধ হবেন না। কারণ মহানবী (সাঃ) কখনও তাদের উপর ক্রুদ্ধ হননি, তিনি জানেন ইসলামের স্থান কোথায়। আল্লাহ তাঁকে বলেন- আপনি তাদের জন্য এত মনকষ্টে ভুগবেন না, তাদের জন্য এত আফসোস করবেন না। আল্লাহ এভাবে সান্ত্বনা দিয়েছেন তাঁর রাসুল (সাঃ) কে।
 আমাদের উম্মাহর আজ কি হয়েছে? প্রতিক্রিয়ার পর প্রতিক্রিয়া, প্রতিক্রিয়ার পর প্রতিক্রিয়াশীল একটি উম্মাহ। আমাকে মানুষের এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় যে – কেন মুসলমানেরা এতো প্রতিক্রিয়াশীল? কেন তারা এত উত্তেজিত হয়ে যায়? আর মুসলমানেরা এর নানা রকম কারণ দেখানোর চেষ্টা করে। আমার খুৎবার শুরুতে তা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। আমরা আমাদের মহানবী (সাঃ) কে এত ভালবাসি, তাই আমরা এত উত্তেজিত হয়ে যাই। এই কারণে পাকিস্তান, লিবিয়া, মিশরের মতো মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে আমরা গাড়ি ভাংচুর করি, ঘরবাড়ি দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ করি- কারণ আমরা রাসুল (সাঃ) কে ভালবাসি। এটা আপনাদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ! আপনারা এই নিয়ে আছেন? অনেকেই হয়তো বলবেন- হ্যাঁ, কেন নয়? কারণ জানেনই তো, এটাই শুধু সমস্যা নয়, আরও অনেক সমস্যা আছে। আমি জানি, আরও অনেক সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে অসন্তোষ আছে। সবাই শুধু একটি সমস্যা নিয়েই প্রতিবাদ করছে না; সমস্যা মূল আরও ব্যপক এবং গভীর। কিন্তু যদি আপনি এবং আমি, অথবা অন্য কোন মুসলমান সেই সব সমস্যা একীভূত করে ইসলামকে ব্যবহার করে এরকম প্রতিবাদ, ভাংচুরের মাধ্যমে  সমাধান করার চেষ্টা করে বলি-‘এগুলো দ্বীনের অংশ’, তাহলে এই কথায় আমাদের ক্ষুব্ধ হওয়া উচিত।  ধরে নেই, মুসলমানেরা প্রতিবাদ করছে, ঠিক আছে। ধরে নেই, তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সামাজিক মূল্যবোধ এই সবকিছু নিয়ে সমস্যা আছে, ঠিক আছে। কিন্তু এতে ইসলামকে টেনে আনবেন না। আমাদের দ্বীনে এসব নেই। এর মধ্যে বিদ্বেষ, ঘৃণার অনুপ্রবেশ ঘটাবেন না। দ্বীন অনেক অনেক সম্মান পাওয়ার অধিকার রাখে।
 বক্তব্যের শেষ প্রান্তে এসে আপনাদের চলে যাওয়ার আগে আরেকটি কথা জানাতে চাই। আবার, আমার যুবক মুসলমান ভাইদেরকে উদ্দেশ্য করে।আজকের দিনে এই পৃথিবীতে আমাদের কাজ হল দ্বীনকে নিজের মধ্যে ধারণ করে দ্বীনের প্রতিনিধিত্ব করা। মানুষকে জানানো যে ইসলাম আসলে কি।আপনার প্রতিবেশীরা কি জানে ইসলাম কি? না। এমনও অনেক মানুষ আছে যারা মসজিদের পাশেই ২০ বছর ধরে বসবাস করছে; অথচ তারা জানেও না ইসলাম কি। ‘মুসলমান লোকগুলো আসে, আমাদের বাগানে তাদের গাড়ি যেনতেন ভাবে পার্ক করে রেখে নামায পড়তে যায়, নামায শেষে গাড়ি নিয়ে চলে যায়। আমরা শুধু জানি এরা প্রতিবেশীদের সাথে মেলামেশা করে না, প্রতিবেশীদের অপছন্দ করে; তাই প্রতিবেশীরাও এদের অপছন্দ করে।’  এই হল মুসলমানদের সম্পর্কে অমুসলিম প্রতিবেশীদের ধারণা। ইসলাম সম্পর্কে এটুকুই হল তাদের অভিজ্ঞতা। আরও দুঃখজনক ব্যপার কি জানেন? যে যুবসমাজ যারা এই নিম্নমানের মানের, কুরুচিকর, হীনবুদ্ধির ফিল্মটি দেখে উত্তেজিত হচ্ছে, সেই একই যুবসমাজ কখনও সম্পূর্ণ কুরআনটি জীবনে একবারও পড়ে দেখেনি। তারা কখনও আল্লাহর কিতাবটি পড়েও দেখেনি। আপনাদের সেইসব ভিডিও দেখার সময় আছে, আর আল্লাহর বইটি পড়ার সময় নেই? আপনারা বুঝতে পারছেন না আসল সমস্যাটি কোথায়? আসল কথা এটা না যে আমরা আমাদের রাসুল (সাঃ) কে বেশী ভালবাসি। আসল কথা হল আমাদের নিজেদের দ্বীন সম্পর্কে আমাদের মূল শিক্ষাটাই নেই। সেটাই সত্যিকারের সমস্যা। আমরা জানি না যে আমাদের দ্বীন আমাদেরকে সভ্যতা শেখায়, আমাদের শালীনতা শেখায়, আমাদেরকে ধৈর্যশীলতা শেখায়, আমাদেরকে অহেতুক প্রতিক্রিয়া দেখাতে বাধা দেয়, আমাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে শেখায়, আমাদের আবেগতাড়িত হতে বাধা দেয়। আমরা সত্যিকারের দ্বীন জানলে আজ ল্যাবরেটরির ইঁদুর মতো হতাম না। আপনারা জানেন ওরা শুধুই টাকা কামাতে চায়। তাই ওরা জানে, মুসলমানদের আক্রমণ করে কিছু বানাও; তারপর দেখ- কেমন তোলপাড় হয়, আমরা কেমন করে আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে চলে আসি, কিভাবে হিট হয়ে যাই। কারণ মুসলমানেরা কি করবে তা তো জানাই আছে। ওরা হল ল্যাবের ইঁদুরের মতো; এদের নিয়ে খেলা করা যায়। একটু খোঁচা দিলেই এরা উত্তেজিত হয়ে যায়। আর আমরাও প্রতিবারই ওদের পাতা ফাঁদে পা দেই। আর এতে যদি কারও কিছু হয় তাহলে তা শুধু ওদেরই লাভ হচ্ছে।
আর হ্যাঁ, এতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি আমরাই এবং আমাদেরই দাওয়াহ প্রচেষ্টার। এখন আমি যদি কাউকে ইসলামের ব্যপারে কোন দাওয়াহ দিতে যাই, আমি তাদের সাথে আল্লাহ্‌ সম্পর্কে কিছু বলতে পারব না, আমি তাদের সাথে আমাদের রাসুল (সাঃ) সম্পর্কে কিছু বলতে পারব না, আমি তাদের সাথে কুরআন সম্পর্কে কিছু বলতে পারবনা; প্রথমেই আমাকে ব্যাখ্যা করতে হয় যে, সব মুসলমানই আসলে ক্ষ্যাপা না। ওরা বলে, ‘আমি CNN দেখলাম তো মুসলমানেরা কি করে, দেখলাম ওরা পুলিশের সাথে কেমন দাঙ্গা ফ্যাসাদ করছে...ইত্যাদি, ইত্যদি’- পুরো আলোচনার মোড় ঘুরে যায়। দ্বীনের বিষয়ে আরও কিছু বলার উপায় আর থাকে না, কারণ আমাকে তখন কোন উত্তেজিত মুসলান ভাইয়ের বুদ্ধিহীন আচরণ সম্পর্কে কৈফিয়ত দিতে হয়। কোন অপরিণত মুসলমান ভাই সম্পর্কে যাকে সহজেই ইচ্ছামতন ব্যবহার করা যায়। আমরা আমাদের উম্মাহর যুবসমাজকে সঠিক শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছি। আবেগকে সামাল দিয়ে বুদ্ধিমত্তার সাথে আচরণ করার শিক্ষা। বুদ্ধিদীপ্ত চিন্তাশীল আচরণ করার শিক্ষা।
আল্লাহ্‌ সুবহানা ওয়াতা’আলা মহানবী (সাঃ)কে করা সবচেয়ে অবমাননাকর কথাগুলোর সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত, চিন্তাশীল জবাব কুরআনে দিয়েছেন। এই হল আমাদের দ্বীন। কুরআনের দুই তৃতীয়াংশই হল এমন সব লোকের সাথে কথোপকথন যারা একে বিশ্বাসও করত না। রাসুল (সাঃ) কি করেছিলেন? এমন সব মানুষকে এটি শোনাচ্ছিলেন যারা একে অবিশ্বাস করত। আর ওরা জবাবে অপমান করত, সমালোচনা করত; আর এই নিয়ে আরও আলোচনা চলত, কেউ কাউকে হত্যা করার প্রচেষ্টা ছাড়াই। আর ওরা যখন মুসলমানদেরকে মেরে ফেলার চেষ্টা করত, মুসলমানগণ স্থির থাকতেন। এবং আল্লাহ্‌ কুরআনে এমন একটি পুরো সময়কালের কথা বলেছেন, যা ছিল মুসলমান ও মুশরিকদের মধ্যকার কথোপকথনের দশক। এমন একটা সময়ের কথা বলেছেন যখন মুসলমানেরা মদিনায় হিজরত করে। আপনাদের কি সেই নীতির কথা মনে পড়ে, ‘কুফফু আইদিইয়াকুম’ বা ‘অস্ত্র সংবরণ কর’? আপনাদের কি সেই সময়ের কথা মনে পড়ে যখন নির্দেশ ছিল- ‘যুদ্ধ নয় আলোচনা’? মনে পড়ে? আমাদের নিজেদেরকে সেই কথাগুলো স্মরণ করাতে হবে কারণ আল্লাহ্‌ সসুবহানা ওয়াতা’য়ালা নিজে তা বলেছেন। আমাদের এত প্রতিক্রিয়াশীল হওয়া থামাতে হবে। আমাদের এভাবে ভাবা বন্ধ করতে হবে- কুরআনের এইখান থেকে কিছু শিক্ষা নিলাম, ঐখান থেকে কিছু নিলাম। পুরো ছবিটা একসাথে বুঝতে চেষ্টা করুন যেটা আল্লাহ্‌ কুরআনে উপস্থাপন করেছেন। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যেন আল্লাহ্‌ আমাদেরকে এই কিতাবের সঠিক জ্ঞান দান করেন। এসব কোনদিনও শেষ হবে না; এই সব অপরিণত প্রতিক্রিয়া, এই সব মূর্খতা ও অজ্ঞতা কখনও দূর হবে না যদি না আমরা আল্লাহর কিতাব থেকে সঠিক শিক্ষা গ্রহন করি। এই কিতাব শুধু আমাদের মনকেই প্রভাবিত করে না, এটা আমাদের হৃদয়ে প্রশান্তি এনে দেয়।
 আল্লাহ্‌ যেন আমাদেরকে, আমাদের পরিবারকে, আমাদের সমস্ত উম্মাহকে সেই শিক্ষায় শিক্ষিত করেন যেমন শিক্ষা আমাদের প্রয়োজন। আল্লাহ্‌ যেন এই উম্মাহ কে অন্ধকার থেকে বের করে আনেন। আল্লাহ্‌ যেন আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন যারা সাহসের সাথে সত্য বলতে পারে, এবং সময় হলে একে অপরের সাথে সভ্য ও সশ্রদ্ধ মতানৈক্যে লিপ্ত হওয়া জানে। এবং আল্লাহ্‌ যেন আমাদেরকে তাদের দলভুক্ত করেন যারা সত্যিকারভাবে এই দ্বীনের সৌন্দর্য ধারণ করতে পারে এবং তা তাদের প্রতিবেশী ও সমস্ত বিশ্বকে দেখাতে পারে। আমীন।

মূল বক্তব্যটি দেখুন এইখানে

No comments:

Theme images by Maliketh. Powered by Blogger.