Wednesday, May 14 2025

আমরা কেমন মুসলমান?

মাসুদা সুলতানা রুমী

..................................................
আমার ছোট ভাই মিজানের সাথে ছোট বেলা থেকেই একটা অসম্ভব ভালো সম্পর্ক ছিলো। বাইরের সব খবরাখবর আমি ওর কাছ থেকেই পেতাম। সারাদিন সময় না পেলেও অন্তত ঘুমের আগে ঘণ্টা খানেক ওর সাথে কথা বলতে না পারলে দিনটা যেনো আমার অপূর্ণ রয়ে যেতো। যদিও যার যার সংসার আর কাজ নিয়ে এখন আমরা খুবই ব্যস্ত। এই ঢাকা শহরে থেকেও আমাদের তেমন একটা দেখা সাক্ষাত হয় না। মোবাইল টেলেফোনে যেটুকু খোঁজ খবর নেওয়া ।
একদিন বেশ রাত করে ঘরে ফিরল মিজান। আব্বা খুব বকা ঝকা করলেন। কিছুক্ষণ আগে আমাদের মহল্লার সবচেয়ে ধার্মিক ব্যক্তিত্ব বোরহান মামা আব্বার কাছে ওর সম্পর্কে কি সব যেনো নালিশ করে গেলেন। ঠিক মতো শুনতে পাইনি, ভাবছিলাম মিজান আসুক ওর কাছেই শুনব। কারণ বোরহান মামা নালিশ করে যাওয়ার পর থেকে আব্বা এতো গম্ভীর হয়ে আছেন যে তাকে আর জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছিলাম না।
মিজান বাসায় আসতেই আব্বা ওকে বকাঝকা করতে লাগলেন। আব্বার কথা বার্তায় যা বুঝলাম তা হলো মিজান বোরহান মামার সাথে বেয়াদপি করেছে। শুনে আমি অবাক। সেকি কথা? মিজান বোরহান মামার সাথে বেয়াদপি করবে কেনো? আগেই বলেছি বোরহান মামা আমাদের মহল্লার সবচেয়ে ধার্মিক ব্যক্তি। শুধু ধার্মিক বললে ভুল হবে। সবচেয়ে ভাল, সৎ আর আল্লাহওয়ালা মানুষ। আর মিজানেরও ভালো ছেলে হিসাবে এলাকায় বেশ সুনাম। সেই মিজান ক্যানো মামার সাথে খারাপ ব্যবহার করবে বুঝে আসছে না। পরে মিজানের কাছে সব শুনলাম।
সামনে নির্বাচন। এবার চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়ে যে তিনজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে সেই  তিনজনই সন্ত্রাসী, বে- নামাজী, মিথ্যাবাদী আর আত্মসাতকারী। মিজানের বয়সী দশ-বারোজন সচেতন যুবক এই বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয় এবারের নির্বাচনে বোরহন মামাকে দাঁড় করিয়ে সবাই জান প্রাণ দিয়ে খেটে বোরহান মামাকে চেয়ারম্যান বানাবে,  ইনশা-আল্লাহ।
কিন্তু এই কথা বোরহান মামাকে বলতেই তিনি স্ব-স্বব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘না বাবা আমি এই সব ফেতনা ফ্যাসাদের মধ্যে নেই।’ মিজানরা তাকে বুঝানোর অনেক চেষ্টা কারে ব্যর্থ হলো। তার ঐ এককথা, এই দুই দিনের দুনিয়া- আর কতোটুকু সময়ই বা আছি? আল্লাহর নাম জপতে জপতে সময়টুকু পার করতে পারলেই হলো। আমি  ঐ সব ফেতনায় জড়াতে চাইনা বাবা। তোমরা ওসব প্রস্তাব আমাকে দিওনা।’
মিজান শেষ চেষ্টা করে বলল, ‘মামা- ঐ জঘণ্য চরিত্রের মানুষগুলো ক্ষমতায় যাবে। গরীবের রিলিফ চুরি করে খাবে। আর আপনার মতো ভালো মানুষ ক্ষমতায় গেলে গরীবের কতো উপকার হতো, সবাই ন্যায় বিচার পেতো।
বোরহান মামা মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলতে লাগলেন, ‘না বাবা আমার পীর কেবলা বলেছেন ‘ বাইম মাছ যেমন কাদার মধ্যে থাকে কিন্তু তার গায়ে একফোঁটা কাদাও লাগে না- তেমনিভাবে এই পাপ পঙ্কিল দুনিয়ায় থাকতে হবে। ঐ সব ফেতনায় জড়ানো যাবে না। মিজান আবার বলল, মামা আপনি এই হাদীসটি তো জানেন, ‘ তোমার সামনে কোনো অন্যায় কাজ সংঘটিত হলে তা হাত দিয়ে ঠেকাও (মানে ক্ষমতা প্রয়োগ করে অন্যায় কাজটি বন্ধ করো)। তা না পারলে মুখে প্রতিবাদ করো। আর তাও না পারলে—।’ মিজানকে হাদীস শেষ করতে না দিয়ে মামা বললেন, ‘মনে মনে ঘৃণা করো।’
তো আমি ঐ সব কাজকে মনে মনে ঘৃণা করি। মিজান বলল, ‘মামা এতো ঈমানের সর্বনিন্ম পর্যায়। এরপর তো ঈমান নেই। আর ঘৃণা করা মানে তো এই না মামা যে আমাদের সামনে খারাপ লোকেরা খারাপ কাজ করবে আর আমরা ঘৃণা করে চুপ চাপ তা দেখব। অথচ ইচ্ছা করলে আমরা ঐ খারাপ লোকদেরকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে পারি। ভালো মানুষ ক্ষমতায় থাকলে সমাজে ভালো কাজের প্রসার হবে। গরীব দুঃখীর উপকার হবে। ইসলামের নিয়ম নীতি মেনে চলতে সুবিধা হবে। মামা বুঝতে পরছেন না ক্যান? ক্ষমতায় যাওয়া খুব—।’ মিজানকে আবারও কথা শেষ করতে না দিয়ে বোরহান মামা বললেন, শোনো মিজান ঐ সব ক্ষমতার লোভ আমাকে দেখাই-ও না।  বলখের বাদশা ইবরাহীম বিন আদহাম (রহ) এত বড় বাদশাহী ছেড়ে দিয়ে আল্লাহকে পাওয়ার জন্য জঙ্গলে চলে গেলেন—।’ মিজানও মামাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বলে উঠলো, ‘মামা রাসূল (সা.) বলেছেন সাত শ্রেণীর লোক আল্লাহ তায়ালার আরশের ছায়ার নিচে স্থান পাবে- যে দিন সূর্যটা অতি নিকটে এসে যাবে আর আল্লাহর আরশের ছায়া ব্যতীত কোনো ছায়া থাকবে না। সেই সাত শ্রেণীর মধ্যে প্রথম শ্রেণী হলো ন্যায় পরায়ন শাসক বা বাদশাহ। ইবরাহীম বিন আদহাম ন্যায় পরায়নতার ভিত্তিতে, ইসলামী আইন অনুযায়ী দেশ চালালেই তো আল্লাহর আরশের ছায়ার নিচে জায়গা পেয়ে যেতেন। তিনি এই হাদীস জানতেন না- নাকি মনে করেছে আল্লাহ বন জঙ্গলে বাস করে।’
মামা এ বার রেগে গেলেন ভীষণভাবে। ‘খবরদার! আর একটা কথাও বলবে না। তোমার সম্পর্কে আমার একটা ভালো ধারণা ছিল। তুমি যে পীর আউলিয়াদের সম্পর্কে এমন বাজে মন্তব্য করতে পারো তা আমার জানা ছিল না-।
মিজানও বলে ফেললো, ‘আমাদেরও আপনার সম্পর্কে এতো দিন ভুল ধারণা ছিল। মনে করেছিলাম সত্যি আপনি ধার্মিক। কুরআন হাদীসের—।’
মামা জোরে বললেন, ‘ আমি তোমার আর কোনো কথা শুনতে চইনা। তুমি আমাকে ঐ সব দুনিয়াদারী আর ফেতনা ফাসাদের দাওয়াত দিওনা। ভোটে দাঁড়ানো তো দূরের কথা আমি ভোট দিতেও যাবো না।’
মিজান উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘সারা রাত আল্লাহু জিকির আর দিনভর রোযা রাখার নাম ইসলম না মামা। ইসলাম একটি মতাদর্শ। ইসলাম অনুযায়ী ব্যক্তি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করা ,ব্যবসা বাণিজ্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা আল্লাহ এবং তার রাসূল (সা.) এর নির্দেশ, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) এর শিক্ষা। আর আপনার পীরের শিক্ষা বাইম মাছের মতো জীবন যাপন।  আপনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) কে বাদ দিয়ে পীর কেবলাকেই মানবেন। আপনি তো এখন আপনার পীর কেবলার উম্মত না শুধু, বান্দাও হয়ে গেছেন। রাসূল (সা.) এর শিক্ষার চেয়ে পীরের শিক্ষাই আপনার কাছে বড়। ঠিক আছে আমরাও দেখে নেব আল্লাহর জমিনে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা না করে- ঘরে বসে জিকির আর দোয় দরুদ পড়ে, ফাঁকি বাজি করে, কি করে আপনি জান্নাতে যান কিংবা রাসূল (সা.) এর সাফয়াত পান। চল—।’
বলে বন্ধুদের নিয়ে চলে এসেছে মিজান।
‘এই সব লোককে ধার্মিক বলে না – এদেরই নাম ধর্মান্ধ। এরা বুঝে সুঝে কুরআন পড়েনা- হাদীসও পড়ে না। এরা শুধু পীর কেবলার সবক আদায় করে। পীর কেবলাকেই সাফায়তকারী মনে করে।’ প্রচণ্ড ক্ষোভের সাথে কথা গুলো বলল- মিজান।
তারপর বড় একটা নিঃশ্বাসের সাথে বলল,‘ এরা কেমন মুসলমান আপা আর এদের পীর কেবলাই বা কেমন মুসলমান?’
মিজানের প্রশ্নের উত্তর তো আমার জানা নেই। পরে আব্বাকে সব বলেছিলাম। আব্বা সব শুনে আমার মতোই লা জবাব হয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ।
তারপর ঠোঁটে একটু ব্যথার হাসি ফুটিয়ে তুলে বললেন, “মিজান কই? খামাখাই ওকে বকলাম!”

Leave a Comment

Theme images by Maliketh. Powered by Blogger.